২০২৪ সালের জুলাই-আগস্ট গণহত্যা: এক রক্তাক্ত অধ্যায়

19 / 100

ভূমিকা

২০২৪ সালের জুলাই ও আগস্ট মাসে বাংলাদেশ ইতিহাসের এক কালো অধ্যায়ের সাক্ষী হয়। ছাত্র-জনতার গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে দমন করতে সরকার ও তাদের সহযোগী বাহিনী যে নির্মম হত্যাযজ্ঞ চালায়, তা আন্তর্জাতিকভাবে নিন্দিত হয়। নির্বিচারে গুলি, রাতের অন্ধকারে অপহরণ, গুম, হত্যা, ধর্ষণ, এবং লাশ অপসারণের মতো নৃশংসতা চালিয়ে সরকার আন্দোলন দমন করতে চেয়েছিল। প্রত্যক্ষদর্শী ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর রিপোর্টে উঠে আসে, রাস্তায় লাশের স্তূপ, হাসপাতালের করিডরে রক্তের হ্রদ, এবং গোপন নির্যাতনকেন্দ্রে বিকৃত মৃতদেহের চিত্র। এই গণহত্যা কেবল সংখ্যায় নয়, পদ্ধতিতে ও নিষ্ঠুরতায় বিশ্বকে স্তম্ভিত করেছিল।


গণহত্যার পটভূমি: ছাত্র আন্দোলনের সূচনা

২০১৮ সালে বাংলাদেশে কোটা সংস্কার আন্দোলন শুরু হয়। সরকার প্রথমে তা বাতিল করলেও, ২০২৪ সালের ৫ জুন হাইকোর্ট কোটা পুনর্বহালের আদেশ দেয়। এই রায়ের বিরুদ্ধে ৬ জুন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা আন্দোলনে নামে

১৪ জুলাই শেখ হাসিনা আন্দোলনকারীদের “রাজাকারের সন্তান” বলে কটাক্ষ করলে পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে ওঠে।

১৫ জুলাই, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় পুলিশ ও ছাত্রলীগ আন্দোলনকারীদের উপর হামলা চালালে প্রথম প্রাণহানি ঘটে। রাফসান আহমেদ (২২), একজন প্রথম বর্ষের ছাত্র, পুলিশের এলোপাথাড়ি লাঠিচার্জে মাথায় আঘাত পেয়ে মৃত্যুবরণ করেন। তার লাশটি ক্যাম্পাসে ফেলে রাখা হয় ঘণ্টাখানেক, যা ছাত্রদের ক্ষোভকে বিস্ফোরিত করে।


গণহত্যার ধাপভিত্তিক বিবরণ

১৬ জুলাই: গণহত্যার সূচনা ও বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের নারকীয় হত্যাকাণ্ড

  • আবু সাঈদ (১৯), বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞানের ছাত্র, ক্যাম্পাস গেটে পুলিশের আঘাতপ্রাপ্ত (এক্সপানসিভ) বুলেট দ্বারা বুক ঝাঁঝরা হয়ে নিহত হন। তার সহপাঠীরা জানান, পুলিশ সরাসরি মুখ ও বুক লক্ষ্য করে গুলি চালায়।
  • ঢাকার শাহবাগে “লাইভ অ্যামুনিশন ড্রিল” নামে অভিহিত এক অভিযানে পুলিশ ও র্যাব যৌথভাবে ৩০০ জনের বেশি ছাত্রকে ঘিরে ফেলে। এ সময় ১৫ জনকে পেছন থেকে গুলি করে হত্যা করা হয়। আহতদের মধ্যে অনেককে হাসপাতালে নেয়ার আগেই গুলি করে মেরে ফেলা হয়।
  • রাতের অন্ধকারে অপহরণ: আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ৭০০-এর বেশি আন্দোলনকারীকে গুম করে। পরিবারদের কাছে পাঠানো হয় “অস্ত্র ও গুলির চার্জ” দিয়ে মিথ্যা মামলা।

২১ জুলাই: ঢাকার রক্তাক্ত রাত – গণকবর ও লাশ পোড়ানোর অভিযান

1000052793 1

২১ জুলাই সরকার সেনাবাহিনী মোতায়েনের ঘোষণা দেয়। রাত ১০টার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি, শাহবাগ, এবং নীলক্ষেত এলাকায় সেনা ও ছাত্রলীগের যৌথ বাহিনী “ক্লিনজিং অপারেশন” শুরু করে।

  • নৃশংসতার বিবরণ:
  • মহিলা হলের ছাত্রী লিমা আক্তার (২১)-কে ছাত্রলীগের সদস্যরা হল থেকে টেনে বের করে গণধর্ষণের পর গলায় তার স্কার্ফ পেঁচিয়ে হত্যা করে। তার বিকৃত লাশ পরদিন সকালে হলের septic tank-এ পাওয়া যায়।
  • শাহবাগ মেডিকেল কলেজের রক্তের হ্রদ: সেনাবাহিনী ৫০ জন আন্দোলনকারীকে হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নিয়ে গুলি করে। রক্তে ভেসে যায় করিডর।
  • লাশ অপসারণ: মৃতদেহগুলোকে গোপনে ডাম্প ট্রাকে করে ঢাকার বাইরে কেরানীগঞ্জের বস্তিতে নিয়ে পুড়িয়ে ফেলা হয়। স্থানীয়রা জানান, ৩ দিন ধরে মানুষের মাংস পোড়ার গন্ধে বাতাস ভারী ছিল।
  • আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের ফুটেজ: বিবিসির একটি undercover রিপোর্টে দেখা যায়, ঢাকা সেনানিবাসের পিছনে গোপন গণকবরে ১০০-এর বেশি লাশ পুঁতে ফেলা হচ্ছে।

২৬ জুলাই: গুমের ভ্যান ও নির্যাতনকেন্দ্রের ভয়াবহতা

  • দ্য গার্ডিয়ানের অনুসন্ধানে প্রকাশ, “সাদা ভ্যান” নামে পরিচিত গুমের যানবাহনগুলো রাতের পর রাত আন্দোলনকারীদের বাড়ি থেকে তুলে নেয়। গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. ফারহান আজিজ-কে ৭২ ঘণ্টা ধরে নির্যাতন করে হত্যা করা হয়। তার দেহে বিদ্যুতায়ন, নখ উপড়ে ফেলা, এবং চোখ তুলে ফেলার চিহ্ন পাওয়া যায়।
  • গোপন কারাগারের রেকর্ডিং: এএফপি একটি ভিডিও লিক করে, যাতে মিরপুরের একটি সেফ হাউসে ২০ জন যুবককে চোখ বেঁধে গরম রড দিয়ে পুড়িয়ে হত্যা করা হয়। চিৎকার থামাতে তাদের মুখে প্লাস্টিকের ব্যাগ ঢুকিয়ে দেয়া হয়।

১-৪ আগস্ট: কারফিউ ও নারী-শিশুদের টার্গেট হত্যা

  • ফেসবুক লাইভে মৃত্যু: ২ আগস্ট, নারায়ণগঞ্জের সরওয়ার্দী স্কুলের ১৪ বছর বয়সী ছাত্রী সানজিদা পুলিশের গুলিতে বাবাকে হারানোর ভিডিও লাইভ করতে গিয়ে নিজেই মাথায় গুলিবিদ্ধ হন। তার শেষ কথাগুলো ছিল, “আমার রক্তে স্বাধীনতা…”
  • মাতৃত্বের উপর হামলা: ঢাকার মিরপুরে পুলিশ একটি অ্যাম্বুলেন্সে গুলি চালায়, যাতে প্রসব ব্যথায় যাওয়া হামিদা বেগম (২৮) ও তার অনাগত শিশু নিহত হন।

গণহত্যার পরিসংখ্যান (জাতিসংঘ, অ্যামনেস্টি ও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের মতে)

ইভেন্টনিহত (আনুমানিক)আহতগ্রেফতার/গুমনির্যাতনের পদ্ধতি
১৬ জুলাই৪০+২,০০০+৭০০+মুখ/বুক লক্ষ্য করে গুলি, গণধর্ষণ
২১ জুলাই১২০-১৫০৫,০০০+১০,০০০+লাশ পোড়ানো, গণকবর, নির্যাতন কেন্দ্র
২৬ জুলাই৪০০+২০,০০০+১৫,০০০+বিদ্যুতায়ন, গরম রড, অঙ্গহানি
১-৪ আগস্ট২০০+৩,০০০+৫,০০০+শিশু-নারী টার্গেট, অ্যাম্বুলেন্সে গুলি
মোট৭০০-৮০০+৩০,০০০+২৫,০০০+

আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া

জাতিসংঘ

জাতিসংঘের মানবাধিকার হাইকমিশনার ভোলকার টার্ক বলেন, “এটি শুধু দমন নয়, একটি পরিকল্পিত গণহত্যা। লাশ পোড়ানো ও গোপন কবরের ঘটনা যুদ্ধাপরাধের স্মৃতি জাগায়।”

অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল

অ্যামনেস্টির রিপোর্টে বলা হয়, “বাংলাদেশের নিরাপত্তা বাহিনী রাষ্ট্রীয় নীতি হিসেবে ধর্ষণকে অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করেছে।”


উপসংহার

২০২৪ সালের গণহত্যা কেবল একটি সরকারের পতনই নয়, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের একটি ডকুমেন্টেশন। ছাত্র-জনতার রক্তে লেখা এই অধ্যায় বাংলাদেশকে শিক্ষা দিয়েছে: অত্যাচারের রাষ্ট্র কখনও স্থায়ী হয় না। আন্তর্জাতিক আদালতে এই অপরাধের বিচার না হওয়া পর্যন্ত বাংলাদেশের মুক্তিকামী মানুষ প্রতিরোধ চালিয়ে যাবে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top